চট্টগ্রাম: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ছবি বিকৃত করে সংসদ সদস্য এম এ লতিফের ফেস্টুন লাগানোর ঘটনায় আওয়ামী লীগে তোলপাড় চলছে। চট্টগ্রামে তৃণমূল নেতাকর্মীরা কোনভাবেই বিষয়টিকে মেনে নিতে পারছেন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে লতিফের বিরুদ্ধে ক্ষোভ এখন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে রাজপথেও। নিজ দলের ভেতর থেকেই এখন রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে লতিফের বিচার করার দাবি উঠছে।
এদিকে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করার ঘটনায় ‘বিতর্কিত’ সংসদ সদস্য এম এ লতিফের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, একটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে লতিফের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবেদন ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনে ছবি বিকৃত করার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন হাস্যকর স্লোগান, বক্তৃতা-বিবৃতি প্রচারের জন্যও লতিফকে অভিযুক্ত করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করে চরমভাবে বিতর্কিত হয়ে পড়া এম এ লতিফ বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন। তার মোবাইল বন্ধ আছে। ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, যে কোন মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ডাক পড়তে পারে, এমন প্রস্তুতি নিয়েই লতিফ ঢাকায় অবস্থান করছেন।
চট্টগ্রাম-১১ আসনের (বন্দর, হালিশহর ও পতেঙ্গা) সাংসদ এম এ লতিফ গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চট্টগ্রাম সফরকে ঘিরে বন্দরনগরীর পতেঙ্গা, বিমানবন্দর থেকে আগ্রাবাদ পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে এসব ফেস্টুন টানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেছেন, ফেস্টুনে ব্যবহার করা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির মুখমণ্ডল বঙ্গবন্ধুর হলেও শরীর তার নয়। অন্য কারও শরীরে কম্পিউটার কারসাজির মাধ্যমে মুখমণ্ডল যুক্ত করা হয়েছে।
ফেস্টুনে ব্যবহার করা ছবিতে দেখা যায়, লম্বা পাঞ্জাবি, চাপা পায়জামা ও পায়ে হালফ্যাশনের কালো জুতা (স্নিকার) পরে বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে আছেন। ছবির নিচে সাংসদ লতিফের নামসহ বিভিন্ন উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, বঙ্গবন্ধু সাধারণত খাটো পাঞ্জাবির সঙ্গে ঢোলা পায়জামা ও স্যান্ডেল পরতেন। কখনো কখনো ওই সময়কার ডিজাইনের জুতাও পরতেন। ফেস্টুনে বঙ্গবন্ধু যে ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন দেখানো হয়েছে, সেভাবে তিনি দাঁড়াতেন না।
এম এ লতিফের নিজের ছবিকে এডিট করে নিজের মুখমণ্ডলের পরিবর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুখমণ্ডল বসানো হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
বঙ্গবন্ধুকে বিকৃত করে ফেস্টুন টানানোর ঘটনায় শনিবার (৩০ জানুয়ারি) থেকেই তোলপাড় শুরু হয়। ফেসবুকে প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি মঙ্গলবার থেকে লতিফের এই কুর্কীতি চট্টগ্রামের রাজনৈতিক মহলে উত্তাপ সৃষ্টি করেছে।
সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, বঙ্গবন্ধু কোন ঠাট্টা-মশকরার বিষয় নয়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সাংসদ লতিফ যে কর্মকাণ্ড করেছেন এজন্য তার কাছে উকিল নোটিশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বাংলানিউজকে বলেন, সবকিছুতে ছাড় দেওয়া যাবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে কোন কম্প্রোমাইজ হবে না। সেটা দলের এমপি হোক আর বড় নেতা হোক, কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে লতিফের বিচার করতে হবে।
মঙ্গলবার সংসদ সদস্য এম এ লতিফের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসিন কলেজে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। বুধবার (৩ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে শহীদ মিনারে জাগ্রত জনতা নামে একটি সংগঠন লতিফের বিরুদ্ধে গণজমায়েতের ডাক দিয়েছে। সেখানে লতিফের কুশপুতুলে থুতু নিক্ষেপের কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়েছে।
এছাড়া বুধবারও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সংসদ সদস্য এম এ লতিফের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ অব্যাহত রেখেছেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে দেওয়া এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুল আজিম রণি লিখেছেন, ‘পাপের শাস্তি পেতে হয়, দিতে হয়। লতিফকে নিয়ে সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিবেন। আপনার বা আমার করণীয় কি তবে? হুম, আপনি-আমি তার সাথে সকল প্রকার রাজনৈতিক সামাজিক বা বন্দর বা মাফিয়াকেন্দ্রিক ব্যবসায়িক লেনদেন বা অংশিদারিত্ব বন্ধ করব। তারপর? তারপর…..জনসম্মুখে দুই চারটা … দিতে হবে। নয়ত মানুষ ভাববে এখনো আমরা বুঝি লতিফ লীগের সৈনিক!’
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মো. আব্দুল মোমিন বিকৃত ছবিটি দিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ইতিহাসের বিরল ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর জন্য লতিফের দেহ দান!!!’
ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম লিখেছেন, ‘এম এ লতিফ প্রথমবার এমপি হবার কয়েক মাস পরেই বন্দরের ঘটনায় তার ওপর হামলা হয়েছিল। সেসময় তিনি অভিযোগ করেছিলেন, বীর চট্টলার সিংহপুরুষ মহিউদ্দীন চৌধুরীর হুকুমে তার ওপর নাকি হামলা হয়েছিল। তবে মহিউদ্দীন সাহেব যদি ওই হুকুম দিয়ে থাকেন আমার মনে হয় তিনি সঠিক কাজটাই করেছিলেন। চলিতেছে সার্কাস……..’
তবে এম এ লতিফ বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেছেন, বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করার সঙ্গে তিনি জড়িত নন। যাদের ফেস্টুন বানানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন তারাই ছবি বিকৃত করেছে।
বরাবর জামায়াত ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এম এ লতিফ ২০০৮ সালে আকস্মিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে মনোনয়ন বাগিয়ে নেন। চট্টগ্রাম-১০ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে লতিফ একের পর এক বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দিতে শুরু করেন।
২০০৯ সালের ৩১ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী সংগঠন চাষী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত যৌতুকবিহীন বিয়ের অনুষ্ঠানে নিজের ছেলের বিয়ে দিয়ে বিতর্কের জন্ম দেন লতিফ। এরপর চট্টগ্রাম চেম্বার ও বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মহিউদ্দিনের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে কয়েকবার লাঞ্ছিতও হতে হয়েছে লতিফকে। বারবার বিতর্কের জন্ম দেয়া লতিফ গত সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে আকস্মিকভাবে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেন। বাংলানিউজ
পাঠকের মতামত: